শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১ ৯ই মাঘ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
Bangladesh Total News
অসময়ে শূন্যে ওড়ে ভালবাসার ছেঁড়া চিঠি,কিছু ভুল পথের ধারে বসে থাকে ছিন্নবস্ত্র ভিখিরির মতো। কেবলি ভাঙে পাড়,বদলে যায় কুলের ঠিকানা,রং ঢং বাইরেই শুধু,
ভেতরটা নেই কারো জানা।
বিকেল থেকেই নীলকান্ত ঘোষের মেজাজ বৈশাখের ঠা ঠা রোদ্দুঁরের মতো তাঁতিয়ে ছিল। কথাটা খগেন তুলেছিল হাটের ভেতর, চেনা মানুষের সামনে। আষাঢ়ের পড়ন্ত বিকেলে হাটের কোনায় নীলকান্ত যখন চুনীলালের কাছ থেকে ঢাউস আকারের নয়খানা ফজলী আম কিনে দাম মেটাচ্ছিল তখনই নওপাড়ার খগেন কু-ু পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘দাদা, ননীরে এট্টু সাবধান কইরেনÑ পরশুদিন আমার গাছের কাঁঠাল চুরি কইরে বন্ধুগেরে নিয়ে বইসে খাইছে।’
‘তুমি কি ননীরে নিজের চোখে কাঁঠাল পারতি দ্যাখছ ?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে নীলকান্ত ।
‘সবাই বলতিছিল!’ একটু দমে উত্তর দেয় খগেন।
‘আমার কি কোনো কিছুর কমতি আছে যে আমার ছেলে মানুষির গাছে হাত দিবি?’
কথার ঝাঁঝ আরও একটু বাড়িয়ে বাড়ি ফেরে নীলকান্ত । তিন ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তেরো বছরের ননী। জন্মের পর ওর ভাগ্যগুণেই যেন নীলকান্ত ঘোষের মিষ্টির দোকানখানা জমে উঠল। এ ছেলে তার সাক্ষাৎ দেবশিশু। মনে মনে খগেনের উদ্দেশে বেশ কিছুক্ষণ খিস্তি আওড়ায় নীলকান্ত ।
রাতের খাবারে পাত পেড়ে বসেছে সবাই। ননীর মা যমুনা দেবী সকলের পাতে তুলে দিচ্ছে হরেক পদের ব্যঞ্জন। বড় মেয়ে শিখা জামাইসহ এসেছে তাই আয়োজন একটু বেশি। খাওয়া শেষে সর পড়া ঘন দুধের সঙ্গে আম। বড় বড় ফজলী আম। নীলকান্ত খেতে খেতে খেয়াল করল একটা আম কম পড়েছে। সে হাট থেকে নয়টা আম কিনেছিল, ননীর মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল সকলকে এক একটা করে দিতে।
‘আর একখান আম কই?’ জানতে চায় নীলকান্ত ।
ননীর মা বলল, ‘আটখানই তো ছিল ব্যাগে!’
নীলকান্ত বলল, ‘আমি নিজে গুনে নয়খান আম আনছিÑ আর একখান কই?’
তর্ক বাড়তে লাগল, নয় নম্বর আম নিয়ে তর্ক। এমনিতেই বিকেলের তাতানো মেজাজ; তর্কের উত্তাপে তা আগুনের হল্কা হয়ে গেল। ননীর মায়ের গালে নীলকান্ত ঠাস্ করে এক চড় বসিয়ে দিল। স্বামীর হাতের চড়, ছেলে-মেয়ে, এমনকি একটু আগে পা ছ্ুঁয়ে প্রণাম করা জামাইয়ের সামনে চড়! ননীর মা যমুনা দেবী স্থির হয়ে যায়।
ঘটনাটা ঘটল ঠিক মধ্যরাতে।
ধীর-স্থিরভাবে সব কাজ গুছিয়ে স্বামী শুয়ে পড়লে তার পায়ে ভক্তিসহ একখানা প্রণাম ঠুকে ঘর থেকে বের হলো। দীর্ঘ দিনের সংসারের ভারে সে বড় ভারাক্রান্ত। একটু হালকা হবার জন্যেই যেন ঝুলে পড়ল ঘরের পেছনের ছাতিম গাছের ডালে।
শ্মশানে চিতা জ্বলছে। যমুনা দেবীর চিতা। ছেলেরা বেহুঁশ। সবচেয়ে বেহাল দশা ননীর, সে জ্বলন্ত চিতার দিকে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। শোকপাথর নীলকান্ত ননীকে শক্ত করে ধরার চেষ্টা করল। গড়াগড়ি খেতে খেতে ননী চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘আগুনের আঁচে মা’র বড় কষ্ট হচ্ছে গো বাবা! ওই আমখান ব্যাগ থেইকে আমিই উঠোয় নিয়ে খাইছিলাম, মা জানে না। আর কোনোদিন চুরি করবো না বাবা, মা’রে তুমি ফিরায় আনো। ও মা,মা তুই ফিরে আয়…!’
মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরাজীব, আশরাফুল মাখলুকাত। বর্তমান সমাজের মানুষ মানবিকতা হারিয়ে যেভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে তাদের কী অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে সে প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হলে বাবা সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
রাজধানীর হাজারীবাগ বটতলা বাজার এলাকায় একটি টিনশেড দোতলা বাড়িতে বাবা তার দুই সন্তানকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে নিজের গলাকেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আহত অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে রোজা (৬) নামে এক শিশুকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত রোজার বাবা জাবেদ ও তার অপর সন্তান রিজন (১৪) আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পারিবারিক কলহের জের হিসেবে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে।
এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? এমন অপরাধ প্রবণ,অসহিষ্ণু ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজ কি আমরা চেয়েছিলাম। দেশে প্রকাশ্যে এরকম লোমহর্ষক নৃশংস ঘটনা যদি একের পর এক ঘটতেই থাকে তা হলে সমাজের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বাধ্য।
এটা সত্য সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে। হেন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। প্রেমের কারণে, অর্থ সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা নিঃসঙ্গতা বঞ্চনা অবিশ^াস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা-মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে,স্ত্রী-স্বামীকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও রেহাই পাচ্ছে না।
অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে নিজের সন্তানকেও হত্যা করা হচ্ছে।
মনের খেয়াল-খুশিমতো চলার নামই হলো প্রবৃত্তির দাসত্ব। নফস বা প্রবৃত্তি মানুষের অন্যতম প্রধান শত্রু। যত শত্রুর বিরুদ্ধে মানুষকে সংগ্রাম করতে হয়, যুদ্ধ করতে হয়, তার মধ্যে প্রবৃত্তি সবচেয়ে কঠিন শত্রু যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অপরিহার্য দায়িত্ব।
বিশ^নবী (সা.) বলেন, প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা সবচেয়ে বড় জিহাদ বা সংগ্রাম। বিশ^নবী (সা.) যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে বলতেন,‘তোমরা এখন ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এসেছ।’
আভিধানিক অর্থে কোনো বস্তুর প্রতি আকর্ষণ এবং ভালোবাসাকে প্রবৃত্তি বলে। পারিভাষিক অর্থে প্রবৃত্তি বলা হয় শরিয়তের আবেদন ছাড়া কামনার চাহিদা অনুযায়ী কোনো বস্তু থেকে স্বাদ গ্রহণের প্রতি মনের আকর্ষণ।
আল্ল¬াহ তায়ালা নফস ও প্রবৃত্তির অনুসরণকে সরাসরি নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা বিচার করতে যেয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।’ (সুরা নিসা : ১৩৫)। অন্য আয়াতে আল্ল¬াহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে দাউদ,আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাসন করো এবং নফসের অনুসরণ করো না, তা তোমাকে আল্ল¬াহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে।’ (সুরা সোয়দ : ২৬)।
আবার অন্যত্র আল্ল¬াহ তায়ালা পথভ্রষ্টদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করাকেও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না, যারা আমার নির্দেশনাবলিকে মিথ্যা বলে,যারা পরকালে বিশ^াস করে না এবং যারা স্বীয় পালনকর্তার সমতুল্য অংশীদার স্থাপন করে।’ (সুরা আনআম : ১৫১)।
আল্ল¬াহ তায়ালা তাঁর নবীকে কাফিরদের উদ্দেশে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন যে, ‘ আপনি বলে দিন,আমি তোমাদের খুশিমতো চলব না। কেননা তাহলে আমি সুপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হব না।’ (সুরা আনআম : ৫৬)।
আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন, ‘এই সম্প্রদায়গুলোর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে, তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।’ (সুরা মায়িদা : ৭৭)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,‘যার হৃদয় আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা,আপনি তার অনুসরণ করবেন না।’ (সুরা কাহফ : ২৮)
এ সকল আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের প্রবৃত্তির কথা বলেছেন অর্থাৎ যারা আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করে। তাদের প্রবৃত্তি তো শয়তানের অনুসরণেই পরিচালিত হয়, সুতরাং তাদের অনুসরণের অর্থই হলো শয়তানের অনুসরণ করা। তাই আল্ল¬াহ তায়ালা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করাকে শক্তভাবে নিষেধ করেছেন।
আবার বিশ^নবী (সা.) ওই ব্যক্তির নিন্দা করেছেন, যে নিজের নফস ও প্রবৃত্তির অনুসরণে গুনাহ করে। হযরত আবু ইয়ালা শাদ্দাদ বিন আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘ অক্ষম ওই ব্যক্তি যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুসারী বানিয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ : ৪২৬০)
নফস ও প্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে পারলেই কোনো মানুষ হয়ে যাবে কামেল মুমিন। আর তখন সে ব্যক্তি আল্ল¬াহ তায়ালার হুকুমের সামনে নিজেকে অবনত করতে পারবে। সে হয়ে যাবে জান্নাতের অধিবাসী। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দ-ায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখে,তার ঠিকানা হবে জান্নাত।’ (সুরা নাজিয়াত : ৪০-৪১)
তবে শুধু প্রবৃত্তি কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তার কোনো শাস্তি হবে না যতক্ষণ তা আমলে পরিণত না হবে।
এ জন্যই বারবার বলা হয়েছে, প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। অনুসরণ বলতে শুধু চিন্তা করাকে বোঝায় না। অনুসরণ হলো বাস্তবে রূপদান করা। সুতরাং যখন কাজে পরিণত হবে তখন তার শাস্তি ভোগ করতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ বনি আদমের ওপর তার জিনার অংশ লিখে রাখা হয়েছে, অবশ্যই সে তা প্রাপ্ত হবে। চোখের জিনা হলো নজর করা, কানের জিনা হলো শ্রবণ করা, জিহ্বার জিনা হলো কথা বলা, হাতের জিনা হলো স্পর্শ করা, পায়ের জিনা হলো গমন করা, অন্তর আকৃষ্ট হয় ও কামনা করে, আর লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবায়ন করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।’ (মুসলিম : ২৬৫৭)।
আমরা যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। নানারকম সামাজিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কি সামাজিক ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি,সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য,উদারতা,কর্তব্যনিষ্ঠা,ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা,শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা,অধ্যবসায়,নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় এতটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বসবাস করে, বিচিত্র এদের মানসিকতা। রুচি। এদের কোনো সমান্তরাল ছাউনির মধ্যে আনা কঠিন। তবে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক অপরাধ কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে। সমাজ রক্ষা করা না গেলে পরিবার রক্ষা করা যাবে না,ব্যক্তিকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
বড় উদভ্রান্ত এ সময়,এলোমেলো স্মৃতির ধারক,পিছু ফিরে চাইলেই কিছু কোলাহল, কিছু অনিষ্ট তোলে ঝড়।
এম এ কবীর
সাংবাদিক,কলামিস্ট
গবেষক,সমাজচিন্তক